ব্র্যান্ড বিল্ডিং নিয়ে তো বহুবার লিখলাম। আজ লিখবো ব্র্যান্ড হত্যা (Brand Killing) করার গল্প! বাংলাদেশের এক সময়কার কয়েকটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড যা হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে, কিভাবে হারালো — সেইসব ঘটনাবহুল ইতিহাস! লেখার আকার বেশ বড় হবে, তাই পুরো লেখাটাকে একাধিক পর্বে ভাগ করেছি। এই লেখাটি প্রায় আড়াই হাজার শব্দের, সুতরাং আপনি যদি একজন ধৈর্য্যশীল পাঠক না হন, তবে এটি আপনার জন্য নয়। স্কিপ করে যেতে পারেন।
শুরুতেই এরোমেটিক হালাল সাবানের কথা বলবো। এই ব্র্যান্ডটা বাজার থেকে কিভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেলো, এ প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই জিগেস করা হয়! আমাকে জিগেস করার কারণ হলো, এ ঘটনাটি আমিই প্রথম বাংলায় লিখিত কোন মার্কেটিংয়ের বইতে উল্লেখ করেছিলাম, আমার দুটো বইতেই এই ঘটনা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ রয়েছে। আমি প্রতিবারই এই প্রশ্নের খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর দেই। তবে আজ একটু বিস্তারিত বলবো।
৯০ দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময় যমুনা গ্রুপ অব ইন্ডাসট্রির অঙ্গসংস্থা “এরোমেটিক কসমেটিকস লিমিটেড” একটা সাবানের ব্র্যান্ড বাজারজাত করে যার নাম দেয়া হয় — এরোমেটিক বিউটি সোপ। এর বিজ্ঞাপনী স্লোগান ছিলো — ”১০০% হালাল সাবান”, অর্থাৎ ক্রেতাদের কাছে একে শতভাগ হালাল সাবান বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। হালাল সাবান হিসেবেই একে দেশজুড়ে তুমুলভাবে মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং করা হয়! বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো হালাল কনসেপ্টের প্রডাক্ট বাজারে ছাড়া হয়নি।
আমি ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাইস্কুলে পড়ার সময় মানিক মিয়া এভিনিউতে এই সাবানের একটা বিশাল বিলবোর্ড বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম, আমার স্পষ্ট মনে আছে — সেখানে বড় বড় করে লেখা ছিলো “১০০% হালাল সোপ।” সেটাই ছিলো আমার চাক্ষুষ দেখা এই প্রডাক্টের প্রথম বিজ্ঞাপন। এরপর একে আমি টিভি, পত্রিকায় দেখি, রেডিওতে শুনি। তৎকালীন জনপ্রিয় মডেল রুমানা ও রিয়া এই টিভিসিগুলোতে অভিনয় করেন, এমনকি রিয়া মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের জন্য মনোনোয়নও পান এই টিভিসির জন্য!
এই সাবানের মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ের দায়িত্ব নেন যমুনা গ্রুপের তৎকালীন Group Marketing Director জনাব সৈয়দ আলমগীর স্যার, যিনি কিনা বর্তমানে আকিজ ভেঞ্চারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও। মাস কয়েক আগে এই গ্রুপ থেকে আয়োজিত বাৎসরিক ইভেন্ট ব্র্যান্ড টক ৩.০ এর স্টেজে বসে তিনি জানালেন যে, হালাল সাবান স্লোগানের আইডিয়াটা তিনি যখন যমুনা গ্রুপের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে পেশ করলেন, তখন কেউই রাজী হননি। তাকে হুবহু কোট করছিঃ
সে সময় যমুনার ম্যানেজমেন্টের ৯৫% বেশী লোক এই আইডিয়ার বিরোধীতা করেছিলো। আমি এসিআইয়ের চেয়ারম্যান স্যারকে একদিন জিগেস করলাম — ধরেন স্যার, আমি যদি বলতাম আমি আপনার একটা প্রডাক্টকে বলতে চাই এক শতো ভাগ হালাল, কি করতেন আপনি? ধরেন আপনার স্যাভলন সাবানকে যদি আমি ১০০ ভাগ হালাল করতে চাইতাম, কি বলতেন আপনি? এন্সারটা আমি দেই স্যার। আপনি বলতেন — মিঃ আলমগীর, টেক আ ব্রেক। গো ফর টু মান্থস লিভ এন্ড থিংক এবাউট ইউর ব্রেইন। আপনার মাথাটা মনে হয় একটু খারাপ হয়ে গেছে! যেটা আমার ওয়াইফ-ও সে সময় আমাকে বলেছিলেন — “তোমার মাথা মনে হয় খারাপ হইসে, সাবান লইয়া পড়সো, সাবানের আবার হালাল-হারাম কি?” তাই না? কিন্তু ঐ যে লোকটা, উইথ অল ডিউ রেসপেক্ট টু মিঃ নুরুল ইসলাম বাবুল (যমুনার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ২ বছর আগে কোভিডে মারা গেছেন), লেখাপড়া উনি একটু কম করেছিলেন, বাট হোয়েন আই সেইড হিম এবাউট ইট (হালাল কনসেপ্ট), তিনি বল্লেন ”ডু ইট! হোয়াটএভার ইউ ক্যান, ডু ইট! ঐ সময় উনি দেশে ছিলেন। আমি বল্লাম, কেউ কিন্তু মানতেছে না! কেউ কিন্তু আমাকে সাপোর্ট করতেছে না। কিন্তু উনি মেনেছিলেন বলেই হালাল (কনসেপ্টটাকে আমি মার্কেটিং Proposition বানাতে পেরেছিলাম।)
আধুনিক মার্কেটিংয়ের জনক ফিলিপ কটলার তার প্রিন্সিপাল অব মার্কেটিং বইতে (১৩ তম এডিশন, ২০১০ সাল) এই ঘটনা আলমগীর সাহেবের নামসহ উল্লেখ করেন! আমি এই কেইসটা নিয়ে বিশদ লিখেছিলাম আমার ১ম বই নন-মার্কেটারদের জন্য মার্কেটিং এর ২য় অধ্যায়ে! আলমগীর সাহেব এই দেশে শুধু হালাল সাবানই না, আমাদের ছোটবেলার প্রিয় পেগাসাস সুজও তাঁর এবং তাঁর টিমের অবদান। যমুনাতে তিনি মাত্র ৬ বছর ছিলেন, এই ৬ বছরে তিনি এরোমেটিক কসমেটিক, পেগাসাস, যমুনা ওয়েলডিং, নিট ও ডাইয়িংসহ ইত্যাকার ডিভিশন লঞ্চ করেছিলেন।
যেভাবে এরোমেটিক হালাল সাবান দেশের বাজার থেকে হারিয়ে গেলোঃ
২০০৫ সালে ভারতীয় মিডিয়ার বরাতে প্রকাশিত, এরোমেটিক কসমেটিকস লিঃ এর কাছ থেকে এরোমেটিক বিউটি সাবানকে কিনে নেয় Marico Bangladesh Ltd (MBL) — যা কিনা ভারতীয় কোম্পানি ম্যারিকো লিমিটেডের বাংলাদেশ শাখা! এই ম্যারিকো অত্যন্ত প্রভাবশালী এক ভারতীয় কোম্পানী, এর হেড অফিস মুম্বাইতে। পৃথিবীর ২৫টি দেশে অপারেশন আছে এই কোম্পানির। বাংলাদেশে চুলের তেলের একচ্ছত্র আধিপত্য ম্যারিকোর! প্যারাসুট নারিকেল তেল (প্যারাসুটের সব প্রডাক্ট ক্যাটাগরির মালিক এই ম্যারিকো), তারপর স্যাফোলা (ড্রাই ফুড ও ভোজ্য তেল), Set Wet (চুলের জেল ও বডি স্প্রে), লিভন (চুলের সিরাম) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের মালিক ম্যারিকো কোম্পানী! ভারতের বাজারে তাদের আরো অনেক ধরনের পন্য রয়েছে! এরাই সে সময় এই দেশের দুই জনপ্রিয় বিউট সোপ ’এরোমেটিক’ এবং ’ক্যামেলিয়া’ কিনে নেয়।
যমুনা গ্রুপের কাছে গিয়ে ম্যারিকো পানির দরে এরোমেটিককে কিনে নেবার প্রস্তাব দেয়, সেই সাথে তারা আশা দেয় যে — এই সাবানকে শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রথমে ভারতের মুসলমানদের ভেতর এবং পরবর্তীতে পৃথিবীর সব কয়টা মুসলিম দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। এরোমেটিক বিউটি সোপ হবে লাক্সের মতই একটা শক্তিশালি ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড! যমুনা গ্রুপে দেখলো, তাদের চাইতেও অনেক বড় একটা কোম্পানি একে যেহেতু কিনতে চাইছে সেহেতু নিশ্চয়ই এই ব্র্যান্ডটি একজন বড় অভিভাবকের হাতে আরো ভালো থাকবে!
সে সময় এরোমেটিক কসমেটিকস লিঃ এর বার্ষিক রেভিনিউ ছিলো প্রায় ৩০ কোটি টাকা! সম্প্রতি জানতে পেরেছি, এরোমেটিক বিউটি সোপ এর অধিগ্রহণ মূল্য ছিলো ৭৮ কোটি টাকা। (কিছু ভ্যাট/ট্যাক্স এর ইস্যু ছিল, সব সহ)
[সূত্রঃ যমুনা গ্রুপের একজন প্রাক্তন উর্ধতন কর্মকর্তা। সে সময় উনি পেগাসাস সুজের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন।]
যা বলছিলাম, ম্যারিকোর এই অধিগ্রহণ সংঘঠিত হবার আগেই এরোমেটিক বিউটি সোপ উল্লেখযোগ্য পরিমান মার্কেট শেয়ার হারায় লিভার ব্রাদার্সের (বর্তমানে ইউনিলিভার)-এর লাক্সের কাছে! যার কারণেই যমুনা গ্রুপ একে বিদেশী কোম্পানীর (দেশী শাখার) কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো, ইউনিলিভার এতটাই আগ্রাসী ও ব্যতিব্যস্ত ছিলো যে, তাদের সাবানে পশুর চর্বি ব্যবহারের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে লাক্সকে আবারো তারা বাজারে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
অবশ্য এটা করতে তাদের বেশ চড়া মাশুল দিতে হয়! কিভাবে? বলছি!
১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাট কারখানায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে লাক্সের সোপ বার উৎপাদন করা হয়। কিন্তু এরোমেটিক হালাল সাবানের চাপে ইউনিলিভার বাধ্য হয়ে লাক্সের বিদেশী কারখানা থেকে লাক্স এই দেশে আমদানী করতে শুরু করে। যার ফলে তাদের বাড়তি ট্যাক্স ও ভ্যাট দিয়ে, বৈদেশিক মুদ্রায় প্রডাক্ট কিনে দেশে বিক্রি করতে হয় অথচ আগের দামই বহাল রাখতে হয়। অর্থাৎ. বাংলাদেশের বাজার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে লাক্স বিপুল পরিমান লোকসান গুনতে শুরু করে! তথাপি ইউনিলিভার এতে ইনভেস্ট করা বন্ধ তো করেইনি, বরং বিনিয়োগের পরিমান অনেকগুনে বাড়িয়ে দেয়। দিনশেষে লাক্স ফিরে আসে সুপারব্র্যান্ড রূপে!
তাছাড়া, আলমগীর স্যারও ততদিনে যমুনা গ্রুপ থেকে রিজাইন দিয়ে জয়েন করেছেন এসিআইতে। অপরদিকে যথাযথ ম্যানেজমেন্টের অভাবে ক্রম্বানয়ে হারিয়ে যায় এরোমেটিক বিউটি সোপ! আলমগীর স্যারের সাথে আমি দেখা করেছিলাম, সম্প্রতি তিনি আমাকে উনার কার্যালয ‘আকিজ হাউসে’ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে দীর্ঘক্ষন ধরে তিনি আমাকে ইন্টারভিউ দিয়েছেন, বিস্তারিত বলেছেন যে কিভাবে এরোমেটিক হালাল সাবানের সূত্রপাত ও যবনীকাপাত হয়। সেই ইন্টারভিউয়ের অডিও রেকর্ড আমার কাছে আছে। আমি সেটা শুনে শুনে টাইপ করে এই লেখার ২য় পর্বটা শীঘ্রই প্রকাশ করবো ইনশাআল্লাহ।
তিনি আমাকে জানালেন, এরোমেটিক হালাল সাবান লঞ্চ করার পর লাক্সের ফ্যাক্টরি টানা প্রায় ৬ মাস বন্ধ ছিলো! ইংল্যান্ড থেকে ইউনিলিভারের বড় বড় কর্মকর্তাদের এই দেশে পাঠানো হয়েছিলো ঘটনা তদন্ত করতে। সাদা চামড়ার অফিসাররা এই দেশের মুদি দোকানে গিয়ে গিয়ে মার্কেট সার্ভে করেছিলো সে সময়, এটা আলমগীর সাহেব নিজের চোখেই দেখেছেন!
১৯৯৭ সালে লাক্স লঞ্চ করে “লাক্স-আনন্দধারা মিস ফটোজেনিক” নামের এক জনপ্রিয় বিউটি কনটেষ্ট (’আনন্দধারা’ হচ্ছে তৎকালীন জনপ্রিয় এক বিনোদনমূলক ম্যাগাজিনের নাম)। এটি ছিলো বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাংগ সুন্দরী প্রতিযোগীতা — যেখান থেকে অপি করিম, মৌসুমী ও তিন্নির মতো নায়িকারা আত্নপ্রকাশ করেন। এর ৬ বছর পর এটি বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু লাক্স থেমে থাকে না। তারা ইনভেস্ট আরো বাড়িয়ে ”লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার” নামে আরেকটা বড় আকারের সুন্দরী প্রতিযোগীতার আয়োজন করে, যা এখনো প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ইউনিলিভার এভাবেই লাক্সের প্রডাক্ট, ডিসট্রিবিউশন ও ব্র্যান্ডিং-ক্যাম্পেইনে ক্রমাগত একের পর এক বড় আকারের ইনভেস্ট করে লাক্সকে বাজারে আগের চাইতেও শক্ত পজিশনে ফিরিয়ে আনে। ফলশ্রুতিতে পেছনে পরে যায় এরোমেটিক। আর যমুনা গ্রুপও আশাহত হয়ে এতে বিনিয়োগের পরিমান কমিয়ে দেয়, কারণ তারা উপলদ্ধি করে যে, আর যাই হোক — শক্তিশালী ব্রিটিশ কোম্পানি ইউনিলিভারের সাথে তারা ঠিক পেরে উঠবে না। তাই পুরোপুরি হারার আগেই তারা রণে ভঙ্গ দেয়। আর ঠিক তখনি একে কেনার প্রস্তাব দেয় ম্যারিকো। এবং খুব সস্তায় ব্র্যান্ডটিকে কিনে নেয়া হয়।
আমার ধারনা, যমুনা গ্রুপের বড় কোন ভিশন ছিলো না এই ব্র্যান্ড নিয়ে। তার উপর ৯৮ সালে যখন আলমগীর সাহেব যমুনা ছেড়ে এসিআইতে জয়েন করেন, তখন এই ব্র্যান্ডটা অনেকটাই নাবিকহীন জাহাজের মত হয়ে পড়ে। একদিকে নাবিক নেই, অন্যদিকে মার্কেট লিডার থেকে আসা ক্রমাগত চাপ, অপরদিকে বিদেশী কোম্পানীর টেকওভার অফার — আমার মনে হয় এই সব কটাই এরোমেটিক সাবান বাজার থেকে হারানোর পেছনে কম-বেশী দায়ী। (ম্যারিকো খুব সম্ভবত পরবর্তীতে কল্লোল গ্রুপের কাছে ক্যামেলিয়া ও এরোমেটিক নামের দুটো সাবানের ব্র্যান্ডই বিক্রি করে দেয়। কারণ কল্লোল গ্রুপের ওয়েব সাইটে আমি দুটো সাবানই একটি ছবিতে দেখেছি। এই ব্যাপারে কেউ বিস্তারিত জানলে আমাকে নক দিবেন প্লিজ।)
মফিক খান নামে এক ফেসবুক বন্ধু জানালেনঃ
যমুনা কখনই বি টু সি ফ্রেন্ডলি কোম্পানী ছিলো না। তার উপর আলমগীর স্যার চলে যাওয়ার পর মার্কেটিং খরচ কমিয়ে আনেন তারা, ততদিনে অবশ্য তাদের একটা অটোসেলস বলয় তৈরী হয়ে গিয়েছিলো, প্রতিষ্ঠানটির একক সিদ্ধান্ত নিতেন স্বয়ং চেয়ারম্যান সাহেব, ডান-বাম কিছু শুনতে চাইতেন না৷ এরোমেটিকের চক বাজারের ডিলার এর পরামর্শ এ পুরো প্রোডাকশনের সাবান চকবাজারে অগ্রীম সেল করতে থাকেন৷ এতে সোপ বেইজড সাপ্লাই চেইন সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে এবং অভিজ্ঞ সেলস পার্সনরাও তাদের সেলস টার্গেট পূরন করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও যমুনা ঘন ঘন মাকেটিং টীম পরিবর্তন করতে থাকে! এরপর বাকিটা ইতিহাস। যা বললাম তৎকালীন বাজারের সরাসরি অভিজ্ঞতার আলোকে বললাম। পারিবারিক ভাবে ঢাকার বেশ কিছু টপ ওয়ান কোং ডিস্ট্রিবিউশন আমাদের ছিলো, এ কারনে বিষয়টা পরিস্কার জানি।”
ম্যারিকো সে সময় এরোমেটিক ছাড়াও আরেকটা দেশী সাবানের ব্র্যান্ড ক্যামেলিয়া বিউটি সোপও কিনে নেয়। তাই তখন অনেকেই ধারনা করেছিলো, পর পর দুটো সাবানের ব্র্যান্ড যেহেতু এরা কিনেছে, তার মানে এরা নিশ্চয়ই আটঁঘাটঁ বেধেঁ বাংলাদেশের বাজারে নিজেদের সাবান ছাড়বে! কিন্তু ইতিহাস বলে, এই ধারনা একেবারেই ভুল ছিলো। ম্যারিকোর কোন সাবান-ব্র্যান্ড ভারতেও নাই, তাহলে কেন তারা এত টাকা দিয়ে দুইটা সাবানের ব্র্যান্ড কিনার পর সেগুলোর ভবিৎষত অনিশ্চিত করে দিলো, সেটা একটা রহস্য ছিলো! তবে আমি এর কারণ হিসেবে যা শুনেছি, তা স্রেফ একটা স্পেকুলেশান, যার কোন রেফারেন্স আমি দিতে পারবো না। আর রেফারেন্স না দিতে পারলে আমি সে তথ্য কোথাও উল্লেখ-ও করি না।
কর্পোরেট দুনিয়ায় অনেক রকম পলিটিক্স চলে, আমি যদি জানতে পারি যে ইউনিলিভার ম্যারিকোকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে, অবাক হবো না। এটা অসম্ভব কিছু না। আবার এমন ঘটেছে, সেটাও বলছি না। মনে রাখতে হবে, ৯০ এর দশকেই কোকা-কোলা কোম্পানী ভারতে পুনরায় প্রবেশ করে তৎকালীন বাজারের নাম্বার ওয়ান বেভারেজ থাম্বস আপকে বেকায়দায় ফেলে পুরো কোম্পানীকে কিনে নেয় (মোট চারটা সফট ড্রিংকস ব্র্যান্ডকে কেনা হয় একত্রে!)। এর ভেতর থাম্বস আপকে কিল করে বাকী তিনটাকে বাজারে রেখে দেয়ার পরিকল্পনা আঁটা হয়। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা সফল হয় না, ইন্ডিয়ানদের বায়িং বিহেবিয়ার তাদের প্ল্যান ভেস্তে দেয়! সে গল্প বিস্তারিত করেছি আমার নন-মার্কেটারদের জন্য মার্কেটিং বইতে।
মোদ্দা কথা হলো, ইউনিলিভার কোনভাবে বাজারে একটা গ্যাপ পেয়েছিলো (কিংবা তৈরী করেছিলো) এবং সেই গ্যাপে তাদের ব্র্যান্ডকে ঢুকিয়ে দিয়ে এর পজিশনিং বরং আগের চাইতেও শক্ত করে ফেলেছিলো; কেননা হালাল সাবান লাক্সকে একটা খুবই মূল্যবান শিক্ষা দিতে পেরেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, বাজারে তাদের চাইকেও শক্ত পজিশনিং তৈরী করা সম্ভব, এবং সেটা খুবই অল্প সময়েই! প্রশ্ন হলো, বাজারে যদি এখন আবার আরেকটা হালাল সাবান আসে, কিংবা এরোমেটিকের সেই হালাল সাবান-ই যদি ফিরে আসে, তাহলে লাক্সের বাজারে আবার ধ্বস নামবে কিনা? বা নামলেও ইউনিলিভার আবার সেটাকে সামাল দিতে পারবে কিনা, ৯০ দশকে যেমন দিয়েছিলো?প্রিয় ব্র্যান্ড প্র্যাকটিশনার্স, কি মনে হয় আপনার?
প্রশ্ন আসতে পারে — হালাল সাবানের আলাপটা এইখানে স্রেফ মার্কেটিং গিমিক কিনা?
সত্যি বলতে, একটা প্রডাক্টকে ইসলামিক শরিয়তের আহকাম মোতাবেক হালাল হতে গেলে একদম কাচাঁমাল থেকে শুরু করে raw materials সহ লাস্ট মাইল ডেলিভারী পযন্ত টোটাল সাপ্লাই চেইনকে হালাল হতে হবে। এরোমেটিকের সাবানটি এই নিক্তিতে হালাল ছিলো কিনা, আমার জানা নেই। তবে এটি “gimmick” ছিলো কিনা, তা জানার আগে আমাদেরকে জানতে হবে Ingredient branding কাকে বলে?এক কথায় বলা যায়, কোন প্রডাক্টের নির্দিষ্ট কোন উপকরণকে ফোকাস করে ঐ প্রডাক্টের যে ব্র্যান্ডিং করা হয় — তাকে ইনগ্রেডিয়েন্ট ব্র্যান্ডিং বলে।
যেমন — মার্কেটিং দুনিয়ায় Ingredient branding এর সেরা উদাহরণগুলোর একটি হলো Intel Inside. ইন্টেল কোম্পানি তো শুধু মাইক্রো প্রসেসর বানায়, পুরো কম্পিউটার না। কিন্তু একটা কম্পিউটারের গায়ে আপনি যখন Intel Inside লেখা দেখেন, তখন আপনি কিন্তু শুধু প্রসেসর না, আস্ত কম্পিউটারটাই কিনতে আগ্রহী হন।অথচ প্রসেসর হচ্ছে একটা কম্পিউটারের কেবলমাত্র ক্ষুদ্র একটা উপকরণ। মানে আপনি কেবলমাত্র একটা ইনগ্রেডিয়েন্টের উপর আস্থা রেখেই পুরো প্রডাক্টটা কিনতে মনস্থির করছেন! বেসিক্যালি দ্যাট ইজ কল্ড ইনগ্রেডিয়েন্ট ব্র্যান্ডিং!
প্রাণীজ চর্বির বদলে সবজির চর্বি ব্যবহার করায় এরোমেটিক বিউটি সাবান উপাদানগতভাবে হালাল ছিলো, এবং এটাকেই মার্কেটিংয়ের হাতিয়ার হিসেবে সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মার্কেটিংয়ের ভাষায় একেও Ingredient branding বলা যেতে পারে। অর্থাৎ, শুধু উপাদান থাকা নয় — বরং নির্দিষ্ট কোন পন্যে নির্দিষ্ট কোন উপাদানের অনুপস্থিতিও Ingredient branding এর আওতাভুক্ত হতে পারে! (যদিও এরপর বাজারে থাকা অন্য দুয়েকটা সাবানও “চর্বি নেই” বলে দাবী করেছিলো বলে শুনেছি, কিন্তু সঙ্গত কারণেই তারা এরোমেটিকের মতো এতটা সাড়া ফেলতে পারেনি।)
আরো দুইটা উদাহরণ দিলে ইনগ্রেডিয়েন্ট ব্র্যান্ডিংয়ের ব্যাপারটা আরো পরিস্কার হবে। যেমনঃ
ক) প্রায় যে কোন ধরনের সয়াবিন তেলেই সাধারনত ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স নামে ২ ধরনের ফ্যাটি এসিড থাকে। কিন্তু দেশের একটা সয়াবিন তেলের ব্র্যান্ড এই তথ্যকে বেশ হাইলাইট করে তাদের ব্র্যান্ডিং করে থাকে। ভোক্তারা ভাবে, শুধু ঐ কোম্পানির তেলেই বুঝি ওমেগা থ্রি ও সিক্স রয়েছে। এ ধরনের চর্চা কিন্তু মোটেও অনৈতিক নয়। বলা যায়, বেশ চাতুর্যপূর্ণ! কারণ তারা কিন্তু স্রেফ দাবী করেছে তাদের তেলে ওমেগা থ্রি আছে। ”শুধুমাত্র তাদের তেলে” রয়েছে — এমন দাবী তারা কোথাও কখনো করেনি! সুতরাং, আইনের ধারা বা নৈতিকতা — কোন মানদন্ডেই আপনি তাদের আটকাতে পারবেন না।
খ) ডায়াবিটিস রোগীদেরকে টার্গেট করে একটা খাদ্যপন্য বাজারজাত করা হয়েছিলো কয়েক বছর আগে, প্যাকেটের গায়ে লেখা ছিলো — ”সুগার ফ্রি”! এই দিয়েই তারা ব্র্যান্ডিং করতো। যা ডায়াবিটিস রোগীদের কাছে জনপ্রিয় ছিলো। পরবর্তীতে ল্যাব টেস্টে দেখা গেলো যে, এতে সুইটেনার রয়েছে। ল্যাব রিপোর্ট হাতে পেয়েই একজন আইনজীবী-ক্রেতা মামলা করে দিলো কোম্পানির নামে! মামলাতে জয়ী হলো কে বলেন তো?
ইনগ্রেডিয়েন্ট ব্র্যান্ডিং করা কোম্পানিটি!
না, জজকে ঘুষ দিয়ে বা অন্য কোন অবৈধ উপায়ে তারা জয়ী হয়নি। স্রেফ নিজেদের চতুরতার কারণে জয়ী হয়ে গেছে। তারা আদালতে বলল, বিজ্ঞাপনে বলা আছে তাদের প্রডাক্ট ”সুগার ফ্রি”! সুইটেনার ফ্রি তো বলেনি। দুনিয়াতে তো চিনি ছাড়াও অন্য অনেক সুইটেনার রয়েছে। যেমন — স্যাকারিন। Sucralose, গ্লুকোজ ইত্যাদি। তাহলে তারা অপরাধী হলো কিভাবে?
অকাট্য যুক্তি! মামলার রায় তাদের পক্ষে চলে গেলো।
এই কারণেই বিদেশে দেখেছি, বড় কোম্পানীগুলোকে মামলা দেবার আগে বাদীপক্ষ প্রচুর স্টাডি করে — কারণ মামলায় হারলে মামলার খরচসহ প্রতিপক্ষকে দিতে হয়। বড় কোম্পানীকে হয়রানির জরিমানার অংকটাও বড় হয় কিনা!যা হোক, এবার এরামেটিকের সাবানে হালাল কথাটি ”মার্কেটিং গিমিক” ছিলো কিনা সেটার উত্তরে বলবো — হালাল সাবানের কনসেপ্টকে আপনি যদি গিমিক বলেন, তবে তো খোদ Ingredient branding কেই গিমিক বলতে হয়!
অবশ্য গিমিক হলেও তাতে কোন দোষ দেখি না। কারণ, গিমিক শব্দের বাংলা করলে দাড়াঁয় — ”জনপ্রিয়তা লাভের উদ্দেশ্যে গন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের যা করা হয়!” ব্র্যান্ডিংয়ের প্রাথমিক কাজই তো ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা! তাহলে তা গিমিক হলে সমস্যা কই?
তা হালাল সাবান বলে দাবী করা এই গিমিকটা কি মিথ্যা? অবৈধ? অনৈতিক? কোনটাই নয়। এটাকে পৃথিবীর কোন মানদন্ডেই আপনি খারাপ প্রমান করতে পারবেন না। এটা একটা সফল ব্র্যান্ডিং স্ট্রাটেজি ছিলো, খামাখা কটলার সাহেব এটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতে তুলে দেননি। মনে রাখতে হবে, ১০০% হালাল সাবান ছিলো একটা স্লোগান, একটা স্ট্রং ইউএসপি! যতটুকু দাবী করা হয়েছিলো, ততটুকু সত্য ছিলো। পুরো মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে এমন কোন দাবী ঐ ব্রান্ডের লোকজন করেনি, যা বাটোয়াট বা ভূয়া ছিলো।
এরোমেটিক ১০০% হালাল সাবান ছিলো এই দেশের তিন ধরনের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির এক সফল উদাহরণঃ
১) হালাল মার্কেটিং
২) ইনগ্রেডিয়েন্ট মার্কেটিং
৩) ডিজরাপটিভ মার্কেটিং
উল্লেখ্য, হালাল সাবান কথাটি এরোমেটিক সাবানের একটি টিভিসিতে উল্লেখ করা হয়নি। কমেন্টে লিংক দিলাম। তার মানে, হয় টিভিসিটা হালাল আইডিয়ার আগে বানানো হয়েছিলো, কিংবা ইচ্ছেকৃতভাবে কোন কারণে একে উহ্য রাখা হযেছে। নাহলে সাবানটাকে যেভাবে পজিশনিং করা হয়েছিলো, সেভাবে হালাল কথাটাকে উহ্য রাখার কোন কারণ দেখি না।
লিখেছেন
প্রলয় হাসান
(চলবে)
COMMENTS